স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের সাথে সর্বপ্রথম ত্রিপুরার রেল যোগাযোগের
মানচিত্রে এই নদীয়াপুর রেল স্টেশনটি সংযোজন হয়েছিল। রাজ্যের প্রবেশদ্বার
চুরাইবারি ও ধর্মনগর রেল স্টেশনের মাঝামাঝি অবস্থিত এই নদিয়াপুর রেল
স্টেশন। তখন রাজ্যে ছিল মিটারগেজ রেল পরিষেবা। ভারতের রেল মানচিত্রের সাথে
রাজ্যের চুড়াইবাড়ি থেকে কুমারঘাট পর্যন্ত সর্বপ্রথম রেল পরিষেবা পৌঁছয়।
প্রতিটি রেলস্টেশনের মতোই নদীয়াপুর স্টেশনটি ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। স্টেশন
মাস্টার থেকে শুরু করে সিআরপিএফ, পোর্টার ও অন্যান্য রেলকর্মীরা এই স্টেশনে
থাকতেন। তাছাড়া এই স্টেশনে ছিল একটি গোডাউন। বানানো হয়েছিল রেলের
কোয়াটার। নদীয়াপুর রেল স্টেশনের আওতাধীন ৭ থেকে ৮ টি গ্রামের অবস্থান।
গ্রামগুলি হলো নদীয়াপুর,কালাছড়া,উত্তর হুরুয়া,গৌরীপুর, লক্ষীনগর। সবকটি
গ্রামের লোকজনরা দূরপাল্লা ট্রেনের পরিষেবা পেতেন নদীয়াপুর রেল স্টেশন
থেকে।
কিন্তু কিছুদিন পর আচমকা নদিয়াপুর রেল স্টেশন থেকে স্টেশন মাস্টার
সিআরপিএফ ও সকল রেল কর্মীগণ অন্যত্র চলে যান। রেল স্টেশনটি সম্পূর্ণরূপে
বন্ধ হয়ে যায়। রেলের গোডাউনটিও কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। সংস্কারের
অভাবে ধীরে ধীরে রেলস্টেশনের রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
রেলস্টেশন ও রেলের কোয়ার্টার গুলি জঙ্গলে ঘিরে ফেলে। শৌচালয় গুলি গভীর
অরণ্যে ঢেকে যায় । যাত্রীদের বসার স্থানও ভেঙ্গে চৌচির। এক কথায় এক
ভুতুড়ে বাংলায় পরিণত হয় নদীয়াপুর রেল স্টেশনটি। স্থানীয় ৭ থেকে ৮ টি
গ্রামের লোকজনরা অসহায় হয়ে নিজের পকেটের টাকা দ্বিগুণ খরচ করে ধর্মনগর
অথবা চুড়াইবাড়িতে গাড়ি রিজার্ভ করে এসে ট্রেন পরিষেবা পেতে হয়।
তারপর
মিটারগেজের পর রাজ্যে এসে পৌঁছায় ব্রডগেজ। ব্রডগেজ আসাতে নদীয়াপুর রেল
স্টেশনের আশপাশের জনগণের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয় হয়তোবা এখনো রেল
কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকার স্টেশনটির দিকে নজর দেবে। আর স্টেশনটি পুনরায় চালু
হলে সাধারণ জনগণের দুঃখ কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। ব্রডগেজ আসাতে রাজ্যে সব রেল
স্টেশনকে আধুনিকরণ করা হয়। নদিয়াপুর রেল স্টেশনটিকেও কিছুটা উন্নত করা
হয় কিন্তু তা শুধু ছিল ব্রডগেজ ট্রেন রাজ্যে প্রবেশ করানোর উন্নতিকরণ। এই
স্টেশনে রেল কর্তৃপক্ষ নতুন করে আর স্টেশন মাস্টার বা অন্য কোন রেল কর্মীকে
নিযুক্ত করা হয়নি। বরং নদিয়াপুর রেল স্টেশনটি আজ গভীর অরণ্যে পরিণত।
সন্ধ্যার পর গোটা রেলস্টেশন চত্বরে সমাজ দ্রোহী ও চোর ডাকাতের আস্তানায়
পরিণত হয়। গোটা স্টেশন চত্বরে গভীর অরণ্য লেগে গিয়েছে। রেলস্টেশন বলুন আর
কোয়ার্টার বলুন কিংবা বাথরুম - যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই জঙ্গল আর জঙ্গল।
স্থানীয় নদীয়াপুর বাসি স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা থেকে আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান সন্ধ্যার পর সমাজ দ্রোহী ও চোর ডাকাতের উৎপাতে তারা
স্টেশনের আশপাশের বাড়ি গুলিতে ঘুমাতে পারেন না। গোটা স্টেশন চত্বরে বিলেতি
মদের বোতলে পা ফেলা অসাধ্য। তাছাড়াও রাতের আঁধারে এই গভীর অরণ্যের মধ্যে
অবস্থিত নদীয়াপুর স্টেশনটিতে নানা অসামাজিক কার্যকলাপও সংঘটিত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন থেকে স্থানীয় জনগণ স্টেশনমাস্টার ও রাস্তাঘাটের অভাবে নদিয়াপুর
রেল স্টেশনের রেল পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। রেল পরিষেবা পেতে হলে হয়তবা
চুড়াইবাড়ি অথবা ধর্মনগর অর্থাৎ ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে পরিষেবা
পেতে হয়।তবে বছর ২ আগে নদিয়া পুর রেল স্টেশনের পাশের বাড়ির মিলন সিনহা
নামের এক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে রেল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে শতকরা ১৫
শতাংশ মুনাফা নিয়ে যাত্রীদেরকে টিকেট দিচ্ছেন। বর্তমানে মিলন সিনহা
নদিয়াপুর রেল স্টেশনে যাত্রীদেরকে টিকেট প্রদান করে আসছেন। তাতে যাত্রীরা
সাময়িকভাবে কিছুটা হলেও নদীয়াপুর স্টেশনে এসে ট্রেন ধরছেন।
স্থানীয়দের
দাবি রেল কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য সরকার যদি ভারতবর্ষের মানচিত্রে ত্রিপুরার
সর্বপ্রথম তৈরি হওয়া নদীয়াপুর রেলস্টেশনটির দিকে একটু নজর দেন তাহলে
স্থানীয় প্রায় ৮ টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ অনেকটা উপকৃত হবেন।
পাশাপাশি স্টেশন চত্বরে তৈরি হবে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। গ্রামবাসীদের
আরও দাবি স্টেশনে রাস্তাটি দীর্ঘদিন যাবত সংস্কারের অভাবে সেটি কৃষি ভূমিতে
পরিণত হয়েছে। তাই স্টেশনে রাস্তাটিও মেরামতি করে দিলে যাত্রীরা অনায়াসে
দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি করে স্টেশনে আসা-যাওয়া করতে পারবে। অনেকে আবার
বলছেন প্রথমে স্টেশনটি অনেক জাঁকজমকপূর্ণ ছিল তারপর কি অদৃশ্য কারণে সেটি
সম্পূর্ণরূপে তালা ঝুলিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরা দীর্ঘদিন থেকে রেল
পরিষেবা পাননি কারণ এক রাস্তাঘাটের সমস্যা, আরেক টিকিটের সমস্যা, আর সবথেকে
বড় সমস্যা হল রাত্রিবেলা এই স্টেশনে কোন যাত্রীর উঠানামা করা বিপদজনক।
কারণ গোটা স্টেশন চত্বরে জঙ্গল আর জঙ্গল। সন্ধ্যা হলেই সমাজদ্রোহীদের
আখড়ায় পরিণত হয় তাই যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারেন
যাত্রীরা।
স্থানীয়দের একটাই দাবি ঐতিহ্যবাহী নদীয়াপুর রেল স্টেশনটি যেন
আরেকটু আধুনিকরণ করে পর্যাপ্ত পরিমাণে রেল কর্মী ও জিআরপিএফ নিয়োগ করেন।
পাশাপাশি একটি ওভারব্রিজ ও একটি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হলে রেলযাত্রীদের
আসা-যাওয়া অনেকটা সুবিধা হবে।তাই নদিয়াপুর বাসী জোরালো দাবি তুলছেন যে,
রেল কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য সরকার যেন স্টেশনটি সংস্কার করে স্টেশন মাস্টার
জিআরপিএফ ও রেল কর্মী নিয়োগ করে তাদেরকে বর্তমান আধুনিক যুগের রেল
পরিষেবার পাওয়ার সুযোগ করে দেন। এখন দেখার বিষয় রেল কর্তৃপক্ষ রাজ্য
সরকার জনগণের দাবি কতটুকু বাস্তবায়ন করে।
0 মন্তব্যসমূহ