
একদিন দেরিতে ফাইল করা গেছে এই প্রতিবেদন। গত ছয়দিন ধরে নিরাপত্তার
ঘেরাটোপে অচল উপত্যকা, বিচ্ছিন্ন সবরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা। দিনের আলোয়
সাধারণের চলাফেরার ওপর থাকে কড়া নিষেধাজ্ঞা, কাজেই রাতের আঁধার নামলে
সতর্কভাবে বাড়ির বাইরে চিকিৎসার খোঁজে বেরোচ্ছেন মরিয়া শ্রীনগরবাসী।
দোকানপাট এখনও বন্ধ, এবং নিরাপত্তা বাহিনীদের বাদ দিলে রাস্তাঘাট প্রায়
ফাঁকা। বন্ধ দরজার আড়ালে ধৈর্য ধরে অন্ধকার হওয়ার অপেক্ষায় মানুষ। উৎকণ্ঠা
ভরা এই অপেক্ষা। কাছাকাছি চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতে ব্যগ্র রুগী,
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েও বাড়ি না যেতে পারা রুগী, উপত্যকার বাইরে পড়তে
যাওয়া ছেলেমেয়ের ফোনের অপেক্ষায় বাবা-মা, বিহারে বা উত্তর প্রদেশে নিজেদের
বাড়ি ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় পরিযায়ী শ্রমিকের দল।
নিত্যদিন রুগী এবং পরিচারকদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা থাকে না যে শ্রী
মহারাজা হরি সিং হাসপাতালে, সেখানে এখন রুগীর সংখ্যা এসে ঠেকেছে তলানিতে।
খাঁ খাঁ করছে করিডর এবং বিভিন্ন ওয়ার্ড, সার বেঁধে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে
অ্যাম্বুল্যান্স। হাসপাতালের এক ডাক্তার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, “এক
এক দিন এমনও গেছে যে বেডের অভাবে একটা বেডে দুজন রুগীকে রাখতে হয়েছে
আমাদের। আজ দেখুন, সব বেড ফাঁকা।” তাঁর আরও বক্তব্য, “ইমারজেন্সিতেও খুব কম
পেশেন্ট আসছেন। আমাদের চিন্তা সেইসব পেশেন্টদের নিয়ে, যাঁদের জরুরি
পরিষেবা দরকার। প্রতিদিন অন্তত দু’ডজন হার্ট অ্যাটাকের কেস আসত আমাদের। এখন
হাতে গোনা কয়েকটা আসছে, তাও শুধু শ্রীনগর থেকে। বাকিদের কথা? জানি না।”
মোট ১১টি চেক পয়েন্ট পার করে শের-ই-কাশ্মীর ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল
সায়েন্সেসে অসুস্থ ছেলেকে দেখাতে এসেছেন আলি মহম্মদ। “প্রতিটা চেক পয়েন্টে
আমাদের বলছিল পাস দেখাতে, কিন্তু আমার কাছে কোনও পাস নেই। সোমবার সকাল থেকে
অসুস্থ আমার ছেলে, প্রথমে কাছাকাছি ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। আজ এখানে নিয়ে
আসা ছাড়া উপায় ছিল না।” শ্রীনগরের শহরতলি থেকে আসা আলি পাসের পরিবর্তে
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখাতে দেখাতে এসেছেন নিরাপত্তা রক্ষীদের।
হরি সিং হাসপাতালে মোটামুটি একই কথা শোনাচ্ছেন উত্তর কাশ্মীরের
বারামুল্লা জেলার আজিজ নজর। “এক আত্মীয়ের সঙ্গে এসেছি হাসপাতালে। দেড়
ঘণ্টার পথ, কিন্তু অসংখ্য ব্যারিকেড, কাঁটাতারের বেড়া, প্রথমে হাইওয়ের ওপর,
তারপর শহরের ভেতরে, হাসপাতালে আসার সব রাস্তায়,” বলছেন আজিজ।
রাত
দশটা নাগাদ শহরের রাস্তা থেকে সরতে শুরু করেন পুলিশ এবং আধাসামরিক কর্মীরা,
কিন্তু হরি সিং হাসপাতালের আশপাশের রাস্তা তখনও বড় বড় লাটাইয়ের মতো পাকানো
কাঁটাতারের বেড়া।
হাসপাতালের প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য সস্ত্রীক
অপেক্ষা করছেন বিলাল আহমেদ, ১৫ কিমি দূরে শালিমারে তাঁর বাড়িতে ফিরবেন
বলে। স্ত্রীর দিকে দেখিয়ে বলছেন, “প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয় ওর, তাই কাছাকাছি
হাবাকের হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে পাঠায় জওহরলাল নেহরু হাসপাতালে,
সেখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে এখানে। এখন ছাড়া পেয়েছে। গত তিন ঘণ্টা ধরে
অপেক্ষা করছি যদি কেউ বাড়ি পৌঁছে দেয়। একজন অটোরিকশা ড্রাইভারকে বললাম ডবল
ভাড়া দেব, কিন্তু কেউ সাহস করে যেতে চাইছে না।”
অ্যাম্বুল্যান্স চালকরাও কেউ বসে নেই। চালক ফিরোজ আহমেদ বলছেন, “পাঁচদিন
বাড়ি যাই নি। আমাদের কাজ হচ্ছে হাসপাতালের স্টাফ, ডাক্তার, টেকনিশিয়ানদের
বাড়ি থেকে নিয়ে আসা দিয়ে আসা। রাস্তায় যদি কোনও পেশেন্টকে বাড়ি পৌঁছে দিতে
হয়, তাও করে দিচ্ছি বিনে পয়সায়।” তাঁর কাছে ‘এসেনশিয়াল সার্ভিসেস’ বা
‘জরুরি পরিষেবা’র আইডি কার্ড থাকলেও যাতায়াতে রীতিমত অসুবিধে হচ্ছে,
জানাচ্ছেন ফিরোজ। কারণ সরকার কারফিউ জারি করে নি, স্রেফ ১৪৪ ধারা লাগু
করেছে। “কারফিউ পাস চাইলে শুনতে হচ্ছে যে কারফিউ তো নেই। কাজেই রাস্তায়
বেরোলে এই আইডি কার্ড সবসময় কাজে লাগছে না,” বলছেন তিনি।
হাসপাতালের বাইরে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে থাকা নিসার আহমেদ বলছেন, “আমরা
এখানে আসি সোমবার, মায়ের চিকিৎসার জন্য। এখন বাড়ি ফিরতে হবে। শোপিয়ান থেকে
একটা অ্যাম্বুল্যান্সের অপেক্ষায় আছি, আশা করছি বাড়ি পৌঁছে দেবে।”
হরি সিং হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপারিন্টেনডেন্ট ডাঃ নাজির হুসেন চৌধুরী
মুখ খুলতে চাইলেন না। “আমার কথা বলার অধিকার নেই,” জানালেন তিনি।
“লকডাউনের (অচলাবস্থার) ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে রুগীদের। বেশিরভাগ
হাসপাতালেই রুগীর সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে। আমাদের কাছেও রুগী খুবই কম আসছেন।
ইমারজেন্সি কেসই বেশি,” বলছেন শের-ই-কাশ্মীর হাসপাতালের এক আধিকারিক।
ডায়ালিসিস কেন্দ্রের কর্মী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন তিনদিন ধরে বন্ধ রয়েছে
তাঁর কর্মস্থান। “যেসব পেশেন্টদের ডায়ালিসিস সাইকেল চলছিল, তাঁদের কী
অবস্থা জানি না,” বলছেন ইশতিয়াক।
0 মন্তব্যসমূহ